সঞ্চয়ের ইতিহাস সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, সঞ্চয় ব্যাংকের জনক হিসেবে খ্যাত রেভারেন্ড হেনরি ডানকান ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে স্কটল্যান্ডের এক গীর্জায় প্রথম সঞ্চয় ব্যাংক স্থাপন করেন। ইংল্যান্ডে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ৬৫ বছর পূর্বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে সরকারিভাবে ‘জাতীয় সঞ্চয় সংস্থা’ আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বযুদ্ধের পর জাতীয় সঞ্চয় সংস্থা ইংল্যান্ডের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। জনগণকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে এ উপমহাদেশে ১৯৪৪ সালে ভারতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সর্বপ্রথম ‘জাতীয় সঞ্চয় সংস্থা’ কাজ শুরু করে। এ সংস্থার প্রধান কার্যালয় ছিল ভারতের সিমলায়।
স্বাধীনতার পর 'পাবলিক ডেট এ্যাক্ট ১৯৪৪’ এর ক্ষমতা বলে ‘জাতীয় সঞ্চয় সংস্থা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তৎকালীন সরকার জনগণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের মাধ্যমে আহরণের জন্য পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক, প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র, বোনাস সঞ্চয়পত্র, ৩ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্র, ৬ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, জামানত সঞ্চয়পত্র প্রবর্তন করে। এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল দেশের জনগোষ্ঠীকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করে সঞ্চয়ের মাধ্যমে আর্থিক নিরাপত্তা সৃষ্টি এবং পরনির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের স্বনির্ভর জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। অপরদিকে সরকারের বাজেট ঘাটতিতে অর্থায়ন এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য জাতীয় সঞ্চয় সংস্থার অবদান অনস্বীকার্য।
১৯৮১ সালে রেমিট্যান্স সংগ্রহের জন্য ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড এর প্রচলন করা হয় এবং একই সাথে সঞ্চয় স্কিমসমূহের বিক্রয় বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ৭টি বিশেষ সঞ্চয় ব্যুরো চালু করা হয়। পরবর্তীতে ৩১জুলাই১৯৮৪ সালে এ দপ্তরটি পরিদপ্তরে উন্নীত হয়। ১৯৮৯-৯০ সালে জেলা সঞ্চয় অফিসগুলো জেলা সঞ্চয় অফিস/ব্যুরো নামে কার্যক্রম শুরু করে।সে সময় একজন পরিচালকের অধীনে সারা দেশে জেলা সঞ্চয় অফিস/ব্যুরোর কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তখন দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সঞ্চয় পরিদপ্তরের কার্যক্রম বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। স্কুল ব্যাংকিং থেকে শুরু করে সঞ্চয় স্ট্যাম্প সংগ্রহ ছিল সঞ্চয় কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
প্রান্তিক ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে সঞ্চয় প্রবণতায় উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তরকে ‘জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর’-এ উন্নীত করা হয়। এ অধিদপ্তরটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের একটি সংযুক্ত অধিদপ্তর।
অভ্যন্তরীণ সম্পদআহরণের পাশাপাশি রেমিট্যান্সআহরণ উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রবাসী/অনিবাসী বাংলাদেশীদের বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ২০০২ সালে ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড নামে দুটি বন্ডের প্রবর্তন করা হয়। সঞ্চয়বন্ডে বিনিয়োগ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভবৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
প্রাইজবন্ডজাতীয় সঞ্চয়অধিদপ্তরের একটি অন্যতম স্কিম।সমাজের সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে সঞ্চয়প্রবণতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এটি চালু করা হয়।সত্তর ও আশির দশকে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই প্রাইজবন্ড সংরক্ষিত থাকতো। বিয়ে জন্মদিনসহ যে কোন পারিবারিক অনুষ্ঠানে প্রাইজবন্ড উপহার হিসেবে দেয়া একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল, যা এখনো প্রচলিত আছে।প্রতিটি প্রাইজবন্ডের বর্তমান মূল্য ১০০ টাকা।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের স্কিমসমূহের লেনদেন কার্যক্রম জাতীয় সঞ্চয় স্কিম অনলাইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এর মাধ্যমে জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংক ও তার অধীনস্থ তফসিলীব্যাংক এবং পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এ ৩টি কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের মাধ্যমে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সঞ্চয় আহরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর জনগণের বিক্ষিপ্তভাবে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের মাধ্যমে আহরণ করে জাতীয় বাজেট ঘাটতিতে অর্থায়ন করে থাকে। এতে জনগণেরজন্য নিরাপদ বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি,সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি, বৈধ পথে রেমিট্যান্স আহরণ বৃদ্ধি এবং ব্যাংক ব্যবস্থা হতে ঋণ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা কমে। ফলে বৈদেশিক নির্ভরশীলতা হ্রাস পায়। তাছাড়া জাতীয় সঞ্চয় স্কিমসমূহের মাধ্যমে দেশের বিশেষ জনগোষ্ঠী যেমন- স্বল্প আয়ের মহিলা, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক, প্রবাসী বাংলাদেশী, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনতে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে সম্প্রতি দুঃস্থ ও অনাথ শিশুদের জন্য নিবন্ধিত আশ্রয় প্রতিষ্ঠান (অনাথ আশ্রম, শিশু পরিবার, এতিমখানা ইত্যাদি) এবং প্রবীণদের জন্য নিবদ্ধিত আশ্রয় কেন্দ্রের অর্থ জাতীয় সঞ্চয় স্কিমেবিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এর পাশাপাশি ক্ষুদ্র সঞ্চয় উদ্বুদ্ধকরণের লক্ষ্যে করদাতা সনাক্তকরণ নম্বর ও আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণক ছাড়াই ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্তসঞ্চয় স্কিমে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
বর্তমানে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের আওতাধীন ১১ (এগারো)টি সঞ্চয়স্কিম চালু রয়েছে। স্কিমগুলো হচ্ছে ৫-বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, ৩-মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র (৩-বছর মেয়াদী), পেনশনার সঞ্চয়পত্র (৫-বছর মেয়াদী), পরিবার সঞ্চয়পত্র (৫-বছর মেয়াদী), ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড (৫-বছর মেয়াদী), ইউ এস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড (৩-বছর মেয়াদী), ইউ এস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড (৩-বছর মেয়াদী), বাংলাদেশ প্রাইজবন্ড (১০০ টাকা মূল্যমান), ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক ক) সাধারণ হিসাব, খ) মেয়াদী হিসাব (৩-বছর মেয়াদী) এবং গ) ডাক জীবন বীমা। জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংক, তফসিলী ব্যাংক ও ডাকঘর এর মাধ্যমে এ সকল সঞ্চয় স্কিমের বিক্রয় এবং নগদায়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ঢাকায় অবস্থিত। ০৮ টি বিভাগীয় শহরে রয়েছে বিভাগীয় কার্যালয় এবং ৬৪ টি জেলা সদরে রয়েছে জেলা সঞ্চয় অফিস/ব্যুরো।এছাড়া সঞ্চয়স্কিমের চাহিদার প্রেক্ষিতে ঢাকা শহরসহ অন্যান্য শহরগুলোতে ১৩টি বিশেষ সঞ্চয় ব্যুরোর কার্যক্রম চলমান রয়েছে।